Wednesday, October 30, 2024

কলকাতার মদনমোহন মন্দিরের ঐতিহাসিক অন্নকূট উৎসব: বাংলার ধর্মীয় ঐতিহ্যের গল্প

 

উত্তর কলকাতার পুরোনো কুমোরটুলি স্ট্রিটের সন্নিকটে অবস্থিত মদন মোহন মন্দির প্রায় ৩০০ বছরের প্রাচীন। সময়ের স্রোতে বয়ে যাওয়া পুরোনো ঠাকুর দালান, প্রাচীন স্তম্ভ, বল রুম এবং শ্বেত পাথরের সিঁড়িগুলি আজ পুরোনো কলকাতার ইতিহাসের প্রতীক। ১৭৬১ সালে সনামধন্য ব্যবসায়ী গোকুল চন্দ্র মিত্র কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এই মন্দিরের সর্বাধিক প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী উৎসব হলো অন্নকূট।

প্রতি বছর কার্তিক মাসে কালী পুজোর বিসর্জনের পরের দিনটিতে  অন্নকূট উৎসব পালন করা হয়। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে এই উৎসবের মাহাত্ম্য ভিন্ন ভিন্ন, প্রতিটি অঞ্চলে এর বিশেষত্ব ও তাৎপর্য রয়েছে।

অন্নকূট উৎসব কি ?

অন্নকূট উৎসব হলো হিন্দু ধর্মের এক বিশেষ পূজা ও উৎসব, যা গোবর্ধন পূজা নামেও পরিচিত। এই উৎসবের  উদযাপনে  ভক্তরা গোবর্ধন পর্বতের পূজা করেন এবং শ্রী কৃষ্ণকে অন্নসহ বিভিন্ন নিরামিষ পদ নিবেদন করেন। কথিত আছে যে,  শ্রী কৃষ্ণ নিজের কনিষ্ঠা আঙ্গুলি দিয়ে  গোবর্ধন পর্বতকে তুলে গ্রামের মানুষদের রক্ষা করেছিলেন, সেই ঘটনার স্মরণে অন্নকূট উৎসব পালিত হয়। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে এই দিনে শ্রী কৃষ্ণকে তাঁর প্রিয় ভোজনীয় পদ নিবেদন করা হয় , যাতে থাকে ভাত, রুটি, সবজি, মিষ্টি এবং অন্যান্য নিরামিষ খাদ্যসামগ্রী।

এবছর অন্নকূট উৎসব কবে ?

এই বছর রা নভেম্বর  মহা সাড়ম্বরে অন্নকূট উৎসব ২০২৪ উদযাপিত হবে। 

ভারতবর্ষের কোথায় কোথায় পালিত হয় অন্নকূট উৎসব?

বারাণসীর অন্নপূর্ণা মন্দিরে মহাসমারোহে পালিত হয় অন্নকূট উৎসব। এটি অন্নপূর্ণা মন্দিরের অন্যতম প্রধান উৎসব। এই দিনে মন্দির প্রাঙ্গণ ফুল এবং আলোকসজ্জায় সুসজ্জিত হয়ে ওঠে। শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভক্তরা সমবেত হন এবং প্রসাদ বিতরণে অংশগ্রহণ করেন। বারাণসী ছাড়াও, ইসকন দ্বারকা, ইসকন জুহু মুম্বাই, শ্রী স্বামীনারায়ণ মন্দির ভাবনগর এবং স্বামীনারায়ণ মন্দির সারাংপুরেও অন্নকূট উৎসব উদযাপিত হয়।

পশ্চিমবঙ্গে, কলকাতার মদনমোহন মন্দিরে স্থাপনের সময় থেকেই অন্নকূট উৎসব উদযাপন শুরু হয়েছিল, যা সত্যিই প্রাচীন ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করে। আসুন, আজ কলকাতার এই প্রাচীন মন্দিরে উদযাপিত অন্নকূট উৎসবের মাহাত্ম্যের গল্প শুনি -

কলকাতার মদন মোহন মন্দির এর ইতিকথা :



উত্তর কলকাতার রবীন্দ্র সরণিতে অবস্থিত মদনমোহন মন্দির একটি শতাব্দী প্রাচীন তীর্থস্থান। প্রতিষ্ঠাতা গোকুল চন্দ্র মিত্র এবং তাঁর উত্তরপুরুষেরা সাত প্রজন্ম ধরে দেবতার (মদনমোহন) পূজা ও মন্দিরের যাবতীয় আচার অনুষ্ঠান পরম্পরাগতভাবে পালন করে আসছেন। ৫ বিঘা জমির উপর প্রতিষ্ঠিত এই মন্দির প্রাঙ্গণে  মূল মন্দির ছাড়াও নাট মন্দির, রাশমঞ্চ, ঠাকুর দালান ইত্যাদি রয়েছে, যা আজও উত্তর কলকাতার ঐতিহ্য বহন করে চলছে। মন্দিরের গর্ভগৃহে মদনমোহন, রাধিকা এবং তাঁর দুই সখি ললিতা ও বিশাখার মূর্তি প্রতিষ্ঠিত আছে, যাঁদের নিত্য পূজা এখানে অনুষ্ঠিত হয়।

মদনমোহন দেবতার ইতিহাস যুক্ত বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজবংশের সঙ্গে। মদনমোহনের মূর্তিটি প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো বলে ধারণা করা হয়। এক সময় এটি দরিদ্র ব্রাহ্মণ পুরোহিত ধরণীর কাছে ছিল, যিনি বিষ্ণুপুরের জঙ্গলে বসবাস করতেন। শিকারে বেরিয়ে রাজা বীর হাম্বির (১৫৯১-১৬১৬) এই মূর্তির সৌন্দর্যে মুগ্ধ  হন এবং ব্রাহ্মণের কাছে মূর্তিটি চেয়ে নেন। ব্রাহ্মণ রাজি না হওয়ায় রাজা মূর্তিটি চুরি করে নিজের রাজ্যে প্রতিষ্ঠা করেন। প্রায় শত বছর পর ১৬৯৪ সালে মল্ল রাজা দুর্জন সিংহ বিষ্ণুপুরে মদনমোহনের মন্দির নির্মাণ করেন।

রাজা গোপাল সিংহের শাসনকালে (১৭৩০-১৭৪৫) মারাঠা সৈন্যরা ভাস্কর রাওয়ের নেতৃত্বে মল্ল রাজ্য আক্রমণ করে। গোপাল সিংহ তাঁর প্রজাদের বিষ্ণুপুর দুর্গের ভিতরে আশ্রয় দিয়ে মদনমোহনের নাম জপ করতে বলেন। স্থানীয় মানুষ বিশ্বাস করেন, মদনমোহন ই স্বয়ং সেই রাতে তাদের  পূর্বপুরুষদের রক্ষা করেছিলেন।

১৭৭০ সালে রাজ্যে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, যখন রাজকোষ প্রায় শূন্য। রাজা চৈতন্য সিংহ তখন মল্ল রাজ্যের রাজা, যিনি ধর্মপ্রাণ এবং ভক্তিমূলক কাজে নিমগ্ন ছিলেন। এই সময়ে, তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁর মন্ত্রী কমল বিশ্বাস রাজ্য পরিচালনা করতেন। এই সুযোগে চৈতন্যের খুড়তুতো  ভাই দামোদর সিংহ সিরাজ-উদ-দৌলার সহায়তায় বিষ্ণুপুর আক্রমণ করেন এবং চৈতন্যকে পরাজিত করে বিষ্ণুপুরের সিংহাসন দখল করেন। চৈতন্য সিংহ পালিয়ে কলকাতায় ব্রিটিশদের কাছে বিচার প্রার্থনা করতে আসেন।

পলায়নের সময় চৈতন্য সিংহ তাঁর আরাধ্য দেবতা মদনমোহনের মূর্তি সঙ্গে নিয়ে আসেন। ব্রিটিশ শাসিত কলকাতায় মামলার খরচ চালানোর জন্য অর্থের প্রয়োজন হলে তিনি বাগবাজারের গোকুল চন্দ্র মিত্রের কাছে ১.৩ লাখ টাকার বিনিময়ে মূর্তিটি বন্ধক রাখেন। তাঁদের মধ্যে চুক্তি ছিল যে চৈতন্য সিংহ ঋণ পরিশোধ করার পর মূর্তিটি ফিরে পাবেন। তবে অনেকে বিশ্বাস করেন, চৈতন্য ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে গোকুল মিত্র মূর্তিটি ফেরত দেননি এবং পরে রাধিকার মূর্তিও স্থাপন করেন।

কিছুজন মনে করেন, চৈতন্য সিংহ ঋণ পরিশোধ করলেও গোকুল মিত্র তাঁকে প্রতিরূপ মূর্তি ফিরিয়ে দেন। আবার কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, গোকুল মিত্র এক রাতে স্বপ্নে মদনমোহনকে দেখতে পান, যিনি জানান যে তিনি তাঁর বাসস্থান ছেড়ে বিষ্ণুপুরে ফিরতে চান। তবে প্রতি বছর কালীপুজোর পরের দিন অন্নকূটের সময় তিনি মাছির রূপ ধরে কলকাতার মন্দিরে আসবেন। সেই থেকে আজও কলকাতার মদনমোহন মন্দিরে অন্নকূট উৎসব উদ্‌যাপিত হয়ে আসছে মহাসমারোহে।উল্লেখ্য , এই কারণেই আজ এই দিনটি তে বিষ্ণুপুরের মদন মোহন মন্দির টি বন্ধ রাখা হয়। 

মদনমোহনে ভোগ নিবেদনের নিয়মাবলী



অন্নকূট উৎসব উপলক্ষে মদনমোহন ঠাকুরকে ৭ মন চালের পোলাও, খিচুড়ি , সাদা অন্ন এবং পায়েসের সাথে নানারকম ভাজাভুজি, মিষ্টান্ন এবং নিরামিষ তরকারির ভোগ নিবেদন করা হয়। এই উৎসবের মূল ভোগ হিসেবে পুই শাকের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

পুই শাক মূল ভোগ হিসাবে প্রচলিত হওয়ার পেছনে মিত্র পরিবারের একটি কাহিনী রয়েছে। একবার এক ভক্ত মদন মোহনের জন্য পুই শাকের তরকারি রান্না করে মন্দিরে নিয়ে আসেন। কিন্তু  সেই দিনের মতন মন্দির  তখন বন্ধ হয়ে গেছে  । দুঃখিত মনে সেই ভক্ত তরকারিটি মন্দিরের সিংহদ্বারে রেখেই  ফিরে যান। পরের দিন মন্দির খোলার পর দেখা যায়, মদনমোহনের মূর্তির হাত-মুখে পুই শাকের খাবার অংশ  লেগে রয়েছে। এই অবিশ্বাস্য  ঘটনার পর মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা গোকুল মিত্র মহাশয় অন্নকূটের ভোগে পুই শাক অন্তর্ভুক্ত করেন, যা আজও পূজার অন্যতম প্রধান ভোগ হিসাবে নিবেদন করা হয় ।

অন্নকূটের মহা প্রসাদ কিভাবে পাবেন ?

অন্নকূট উৎসবের দিন মধ্যাহ্নে মিত্র পরিবারের ঐতিহ্য অনুযায়ী মূল মন্দিরের দ্বিতল বারান্দা থেকে "চাঁদনী" প্রথায় ভক্তদের মধ্যে পরমান্ন ছুড়ে বিতরণ করা হয়। শত শত ভক্ত মন্দির প্রাঙ্গণ এবং চিৎপুর ট্রামলাইন জুড়ে কাপড়ের আঁচল, ছাতা ইত্যাদি দিয়ে প্রসাদ সংগ্রহ করেন। প্রায় তিন শতাব্দী ধরে চলে আসা এই প্রথা আজও মিত্র পরিবারের সপ্তম প্রজন্মের মাধ্যমে জীবিত রয়েছে।

চাঁদনী প্রথা শেষ হলে ভক্তদের হাতে হাতে শালপাতার থালায় ঠাকুরের মূল ভোগ—পুঁই শাক সহযোগে অন্ন—বিতরণ করা হয়।

মদন মোহন মন্দিরে যাবেন কিভাবে?

ঠিকানা : ৫২০,রবীন্দ্র সারণি , বাগবাজার, কুমারটুলি , কলকাতা - ৭০০০০৫

গুগল ম্যাপ অনুসরণ করুন ।

মন্দির দর্শনের সময় : দিবা ৬টা - ১২ টা এবং বিকাল ৪টে- ৮: ৩০ টা (প্রতিদিন) 

উপসংহার

মদনমোহন মন্দিরকে ঐতিহ্যবাহী হিন্দু মন্দিরের সাথে তুলনা করা চলে না। এটি বরং ইউরোপীয় শৈলীতে নির্মিত এক প্রাসাদোপম স্থাপত্যের সঙ্গে তুলনীয়। বিশাল কাঠের দরজা পেরিয়ে দ্বিতল ভবনের ভেতরে প্রবেশ করলেই বিস্তৃত উঠানের মাঝে বিশাল স্তম্ভগুলো দর্শকের চোখে মুগ্ধতা আনে। শ্বেত পাথরের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতেই সুবিশাল বলরুমে রৌপ্য সিংহাসনে অধিষ্ঠিত  মদন মোহনের মূর্তি দর্শন সত্যিই এক স্বর্গীয় অনুভূতি এনে দেয়।



অন্নকূট উৎসব উপলক্ষে এই বিশেষ দিনে পশ্চিমবঙ্গের প্রায় প্রতিটি জেলা থেকে শতাধিক ভক্তের সমাগম ঘটে মন্দির প্রাঙ্গণে। তাঁরা পুজো দেন, প্রসাদ গ্রহণ করেন এবং মানত রাখেন। অন্নকূট ছাড়াও মন্দিরে ঝুলন, রাশযাত্রা, ফুলদোল, দোল পূর্ণিমা প্রভৃতি উৎসব সাড়ম্বরে পালিত হয়। বিশেষত,  রাশযাত্রায় ঠাকুরের নাটমন্দিরে আরোহন উপভোগ্য এক অনন্য দৃশ্য, যা ভক্তদের বিভোর করে তোলে।

ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণের পদধন্য এই মন্দির ও তার আশপাশের এলাকা ধীরে ধীরে সেজে উঠছে অন্নকূট উৎসব ও মেলা উদযাপনের জন্য। উল্লেখ্য, ১৮৯৩ সালে শিকাগো ধর্মসভা থেকে ফিরে এসে স্বামী বিবেকানন্দ এই মন্দিরের ঠাকুর দালানে দাঁড়িয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা সর্বপ্রথম বাংলার মানুষদের সাথে ভাগ করে নিয়েছিলেন।

অন্নকূট এর এই  পুণ্য তিথিতে  আসুন আমরা সকলে মিলে মদন মোহনের আশীর্বাদ প্রার্থনা করে অন্নকূট উৎসব ২০২৪  উদযাপন করি!

Disclaimer
This blog has been crafted using information from Google & various sources, so if you spot any factual errors, please inform me, and I will rectify them. 


No comments:

Post a Comment

ঢাকার দেবী মা ঢাকেশ্বরীর অন্দরমহল কলকাতার কুমারটুলি তে

  “তুমি অন্নপূর্ণা মা শ্মশানে শ্যামা ,           কৈলাসেতে উমা ,  তুমি বৈকুন্ঠে রমা , ধর বিরিঞ্চি - শিব - বিষ্ণুরূপ সৃজন - লয় - ...