কৈলাসেতে উমা, তুমি বৈকুন্ঠে রমা,
ধর বিরিঞ্চি-শিব-বিষ্ণুরূপ সৃজন-লয়-পালনে।।“- স্বামী কৃষ্ণানন্দ
'কালীঘাটে
আছেন কালী/ ঢাকেশ্বরী ঢাকায় '- না এই তথ্য সর্বৈব সত্য নয় । "ঢাকেশ্বরী মাতার"
সংসার কলকাতার বুকে কুমোরটুলির অন্দরে। হ্যাঁ ঠিক ই পড়লেন - ঢাকেশ্বরীর উমা কোনো এক
অজানা কারণে সপরিবারে, স্বমহিমায় আজ ও কুমোরটুলির
অন্দরমহলে বিরাজমান।
আসুন
একবার ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখে নি আসল সত্যি টা কি –
ঢাকার মা এর ইতিবৃত্ত
কুমারটুলি
তে স্থাপিত মাতৃমূর্তিটি বেশ প্রাচীন, যার
সাথে জড়িয়ে আছে বাংলার সেন রাজ্ বংশের ইতিহাস । কথিত আছে যে, রাজা বিজয় সেন এর স্ত্রী
একটি বাঁধ থেকে স্নান করে ফেরার সময় পথিমধ্যে এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেন, যিনি পরবর্তীকালে
বল্লাল সেন নামে সেন রাজবংশের সমৃদ্ধির রথকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন ।
সিংহাসন আরোহণের পর বল্লাল সেন (১২ খ্রিস্টাব্দ) তাঁর জন্মস্থান অবিভক্ত বাংলার ঢাকা জেলায়
একটি মন্দির নির্মাণের পরিকল্পনা করেন, যা ঢাকেশ্বরী
মন্দির নামে পরিচিত হয়। শোনা যায় যে, রাজা বল্লাল সেন মাটি খনন করে ৮০০ বছরের প্রাচীন দূর্গা মূর্তির সন্ধান
পান,এবং তিনি তা ১০০০ ঢাকের বাদ্যি সহযোগে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
অ্যালেন
(১৯১২) ইস্টার্ন বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার্স (ঢাকায় প্রকাশিত) তার প্রবন্ধে উল্লেখ করেছে যে “মন্দিরটি বল্লাল সেন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত
হয়েছিল ঠিকই ,পরে অবশ্য রাজা মান সিং কর্তৃক পুনর্নির্মাণ করা হয়, কিন্তু ওই পুরাতন
মন্দিরটির কোনও চিহ্ন আজ আর অবশিষ্ট নেই । বর্তমান
বাংলাদেশের জাতীয় মন্দির এর স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ঢাকার ঢাকেশ্বরী মন্দিরটি প্রায়
দুইশ বছর আগে কোম্পানির একজন কর্মচারী দ্বারা নির্মিত হয়েছিল বলে জানা যায়।"
ঢাকেশ্বরী মা এর পূর্ববঙ্গ হতে পশ্চিমবঙ্গে যাত্রা
সময়টা
১৯৪৭ সাল, বঙ্গভঙ্গের পরই পূর্ববঙ্গ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, হানাহানি, ও লুঠতরাজে উত্তপ্ত।
এমতাবস্তায় কিছু প্রভাবশালী হিন্দু ঢাকেশ্বরীর মা কে রক্ষা করার জন্য, তাঁকে কলকাতায় স্থানান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেন। যেমন ভাবা তেমনটি কাজ !১৯৪৮ সালে হরিহর চক্রবর্তী
, রাজেন্দ্র কিশোর তিওয়ারি (সেবায়েত ) , ও লালাবাবু ওরফে ব্রজেন্দ্র দুবে একটি বিশেষ
বিমানে চেপে মা ঢাকেশ্বরীকে অতি সন্তর্পনে পোশাক ও অলংকার ছাড়াই একটি সাধারণ সুটকেসে
এ কাপড় ও কাগজ দিয়ে ঢেকে নিয়ে এদেশে চলে আসেন।
১৯৫০ সালের ২৭ শে জুন বাংলা দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে এই ঘটনার প্রমান মেলে।"ঢাকেশ্বরী -উমা" র অস্থায়ী নতুন ঠিকানা হয় কলকাতায় বঙ্গ লক্ষী কটন মিলের কর্ণধার তথা তৎকালীন সুপ্রতিষ্ঠিত শিল্পপতি দেবেন্দ্রনাথ চৌধুরীর হরচন্দ্র মল্লিক স্ট্রিটের বাড়িতে। পরবর্তীকালে অবশ্য চৌধুরী পরিবার কলকাতার কুমারটুলি র একটি জমি মন্দির কমিটি কে দান করেন, এবং সেই স্থানেই ১৯৫০ সালে ঢাকেশ্বরী মাতার স্থায়ী সংসার স্থাপিত হয়।
"একবার
বিরাজ গো মা হৃদি কমলাসনে।
তোমার
ভুবন-ভরা রূপটি একবার দেখে লই মা নয়নে।"
১.৫
ফুট লম্বা অষ্টধাতু দ্বারা নির্মিত সোনালী বর্ণের মাতৃমূর্তি দশ হাত বিশিষ্ট কাত্যায়নী
দুর্গার রূপে (যা দেবী মহিষাসুরমর্দিনীর একটি রূপ) কুমারটুলির ঢাকেশ্বরী মাতার মন্দিরে অধিষ্ঠান করছেন। । তার দুই পাশে লক্ষ্মী,
সরস্বতী, কার্তিক এবং গণেশ; অন্যদিকে দেবীর বাহন পৌরাণিক সিংহ অনেকটা ঘোঁটকাকৃতি।
মূর্তির
পিছনের দিকের চালচিত্র এবং সিংহাসন রূপার তৈরি ।
এছাড়াও রাম ও হনুমানের দুটি পৃথক মাটির মূর্তি নমস্কার মুদ্রায় দেবীকে শ্রদ্ধা
জানাতে সিংহাসনের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন ।
পূর্ববঙ্গে মা এর প্রতিরূপ
প্রতিরূপ নির্মাণের জন্য ৯০ এর দশকে ঢাকার মন্দির পরিচালনা কমিটির একটি দল কুমোরটুলির ঢাকেশ্বরী মাতার মন্দির এ এসে আসল মূর্তিটির ছবি তুলে নিয়ে যান। তবে ঢাকায় মায়ের যথার্থ প্রতিরূপ নির্মিত হয়নি ।
কুমারটুলি
র মাতৃমূর্তি আটটি হাতে কোনো অস্ত্র নেই ,সে গুলি বন্ধ বা খোলা অবস্থায় আশীর্বাদী মুদ্রা
রূপে পরিলক্ষিত, শুধুমাত্র
দুই হাতে ত্রিশূল ধারণ করে মহিষাসুরের বধ করছেন মা। অন্যদিকে বর্তমান ঢাকা য় মাতৃমূর্তি দশ হাতে অস্ত্রধারণ
করে মহিষাসুরমর্দিনী রূপে পূজিত হন। তবে, মায়ের উভয় অবতারই খুব সুন্দর।
পূজাবিধি
আশ্বিনের
শারদপ্রাতে কুমোরটুলির ঢাকেশ্বরী মাতার মন্দিরে উত্তর ভারতীয় “নবরাত্রি রীতি” মেনে
বিশেষ পুজোর আয়োজন করা হয়। বর্তমানে মন্দিরের
প্রধান পুরোহিত শক্তি ঘোষাল জানান যে দুর্গাপূজার সময়, ৩টি মঙ্গল ঘটে ১২টি মাটির প্রদীপ
স্থাপন করা হয়।
বাঙালি
মতে এই মন্দিরে সপ্তমী থেকে দশমীতে দূর্গা পুজো র আয়োজন করা হয়। । একসময়
ঢাকার ঢাকেশ্বরী মন্দিরের ন্যায় এখানেও বলি প্রথার প্রচলন ছিল। কিন্তু বর্তমানে তা সম্পূর্ণ রূপে বন্ধ হয়ে গেছে। সন্ধি পুজোর সময় শুধু চাল কুমড়ো বলি দেয়ার রেওয়াজ
আছে।
ভোগ নিবেদন
মহাসপ্তমী
তে ভোগ হয় পঞ্চব্যঞ্জন ও চাটনি, মহাঅষ্টমী
তে ভোগ নিবেদন করা হয় পোলাও, খিচুড়ি, সবজি, চাটনি ও পায়েস, মহানবমীতে আয়োজন করা হয়
পোলাও ও পুরীর। প্রতি বছর মহাঅষ্টমী তে ভক্তদের
খিচুড়ি প্রসাদ বিতরণ করা হয়।
পরিশেষে,
কথিত
আছে, ঢাকেশ্বরী মাতার নামেই মধ্যযুগে নামকরণ হয়েছিল বর্তমান ঢাকা শহরের। সময়ের
পরিক্রমায় দেশভাগের প্রেক্ষাপটে, কলকাতার পটুয়াপাড়ার বুকে মা ঢাকেশ্বরী তার স্থায়ী
সংসার গড়ে তুলেছেন।
দুই
বাংলার ইতিহাস ও সংস্কৃতির এক অনন্য সেতুবন্ধন রূপে আজও তিনি কুমারটুলির সরু গলিতে
তাঁর ভক্তদের আশীর্বাদ দিয়ে চলেছেন । ডঃ শ্যামল চৌধুরী (দেবেন্দ্রনাথ চৌধুরীর নাতি)
দুঃখ প্রকাশ করে বলেন যে, "কলকাতা আদি ঢাকেশ্বরীর আবাসস্থল হয়ে উঠেছে, কিন্তু
খুব বেশি লোক এটি সম্পর্কে জানে না।" তাই যারা এখনো মাকে দর্শন করেননি, এই
"চৈত্র নবরাত্রির" পুণ্যতিথিতে একবার এসে ৮০০ বছরের প্রাচীন মাতৃমূর্তি দর্শন
করুন।
আসুন,
ইতিহাস, ও ঐতিহ্যের এই অসামান্য মেলবন্ধনের
সাক্ষী হই এবং মাতৃস্নেহের পরশ নি।
বিশেষ দ্রষ্টব্য
ঠিকানা
( গুগল ম্যাপ ) : ১/৩এ
কুমারটুলি স্ট্রিট। কলকাতা - ৭০০০০৫
দর্শনের
সময় : দিবা ৭ টা - ১২
টা এবং বিকাল ৪টে- ৯ টা (প্রতিদিন)
সন্ধ্যারতির
সময় : বিকাল ৬ টা (
গরমকাল ), বিকাল ৫ টা (শীতকাল )
Disclaimer
This blog
has been crafted using information from Google & various sources, so if you
spot any factual errors, please inform me, and I will rectify them.
TAGS: বাংলার মন্দির স্থাপত্য, ঢাকেশ্বরী মন্দির (ঢাকা, বাংলদেশ)
No comments:
Post a Comment